» বিচারের জন্য হাসিনাকে দেশে ফেরানো উচিত

প্রকাশিত: 01. September. 2024 | Sunday

সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এস কে সিনহা) সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচার চেয়েছেন। শেখ হাসিনাকে বিচারের মুখোমুখি করতে তাকে ভারত থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসারও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, হত্যা-লুটতরাজের দায় শেখ হাসিনাকে নিতে হবে। সরকারের উচিত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা। বর্তমানে কানাডার টরন্টোতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা ৭৩ বছর বয়সি এস কে সিনহা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন।

৩১ আগস্ট নিউইয়র্ক থেকে টেলিফোনে বিচারপতি এস কে সিনহার এ সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করা হয়। সাবেক সরকারের রোষে পড়ে দেশ ছাড়া এস কে সিনহা নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেলে দেশে ফিরে আসতে চান।

দেশ থেকে জোরপূর্বক বিতাড়ন, চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ার বিরুদ্ধে কোনো আইনগত পদক্ষেপ নেবেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার ব্যক্তিগত কোনো ক্রোধ, অনুরাগ, বিরাগের চেয়ে আমি দেশে এমন কোনো অন্যায় যাতে আর না হয় সেদিকেই জোর দিচ্ছি। এর চেয়ে বড় জিনিস হলো, শেখ হাসিনা হত্যা করেছে, লুট করেছে, শেখ হাসিনা ডাইরেক্টলি না করলেও তার লোকজন লুট করেছে, সে সময় সে (শেখ হাসিনা) চোখ বন্ধ করে ছিল, তাই তাকেই চুরির দায়িত্ব নিতে হবে। কারণ, সবাই তার লোক। কেউ ব্যাংকের ডাইরেক্টর হওয়া, চেয়ারম্যান হওয়া, ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের লোন শেখ হাসিনার অনুমতি ছাড়া কেউ পায়নি। যার পরিপ্রেক্ষিতে সবকিছুর দায়িত্ব শেখ হাসিনাকেই নিতে হবে। আইন এখানে পরিষ্কার-হত্যা এবং লুটতরাজের দায় শেখ হাসিনাকে নিতে হবে। টিভির টকশোতে একজন অতিথি গত শুক্রবার বলেছেন, গুম-অপহরণের বিচারের কোনো আইন নেই। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, দেশে আইন আছে। সে আইনের প্রয়োগ কীভাবে করতে হয় সেটি না জানার দায় তাদেরই। দেশের প্রচলিত আইনেই সব গুম-অপহরণের বিচার সম্ভব।
শেখ হাসিনা আর কত দিন ভারতে থাকতে পারবেন? এ ব্যাপারে তার পর্যবেক্ষণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার কীভাবে তাকে ফিরিয়ে আনবে এটা উভয় দেশের সরকার আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করবে। তবে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যেহেতু হত্যা মামলা হয়েছে, তাই অপরাধের বিচারের স্বার্থেই তাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে নেওয়া উচিত। শেখ হাসিনার মতো একজন নেত্রী এত প্রতাপশালী ছিল, সে পালিয়ে যাবে এটা আমার চিন্তার মধ্যে ছিল না। তার হাজার হাজার, লাখ লাখ কর্মী ছিল, দেশপ্রেম ছিল বলে দাবি করেছে, তাহলে দেশপ্রেম থাকলে কি কেউ পালিয়ে যায়? তার তো ফেস করা উচিত ছিল। কারণ সে দুর্নীতিবাজ ছিল, আইনকে শ্রদ্ধা করত না, গুরুতর অপরাধ করেছে বলেই সে পালিয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যেসব বড় বড় বুলি আউড়েছে তার সবগুলো ছিল মিথ্যা। এগুলো সে বিশ্বাস করত না। তাই সরকারের উচিত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ভারত সরকারকে জানানো যে, তার বিরুদ্ধে হত্যা, দুর্নীতির অনেক মামলা রয়েছে, তাই তাকে প্রত্যর্পণ করো। তিনি বলেন, এই পরিবর্তিত পরিস্থিতি সম্পর্কে অনেক আগেই আঁচ করেছিলাম। বিভিন্ন বক্তব্যেও বলেছিলাম যে, শেখ হাসিনার পতন যে কোনো মুহূর্তে। আজ হবে, কাল হবে, নাকি এক বছর পর হবে, তার পতন হবেই। কারণ, কোনো স্বৈরশাসক একটি দেশকে তার পৈতৃক সম্পত্তি হিসেবে চালিয়ে যেতে পারে না। তাহলে ইতিহাস ভুল হয়ে যাবে। আমার আভাস সঠিক ছিল। এস কে সিনহা বলেন, আমার আভাসের প্রতিফলন ঘটেছে জেনে ভালো লাগছে। তবে আমি মনে করি, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারে অনেক বিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ আছেন, প্রফেসর ইউনূস একজন ভালো মানুষ, তাঁরা ভালো করবেন। তাদের চাওয়া-পাওয়ার কিছুই নেই। একটি জিনিস হলো, আপনার যদি কোনো প্রত্যাশা না থাকে অর্থাৎ আমি কাজ করলাম বিনিময়ে কী পাব, এটা যদি না থাকে যে কোনো নেতার, তাহলে দেশের মঙ্গল হবেই। আমি একটি উদাহরণ দিতে পারি মহাত্মা গান্ধীর। উনি রাজনীতি করেছেন। এত অত্যাচার, জোর-জুলুম সহ্য করে। উনি কিন্তু ব্যক্তিকেন্দ্রিক কিছুই প্রত্যাশা করেননি। যার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত এত বেশি জনসংখ্যা, এত ভাষাভাষী, জাতপাত হওয়া সত্ত্বেও এখনো গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত রয়েছে বলেই দেশটি টিকে আছে। আমি আশা করি, আমার দেশের অ্যাডভাইজার যারা আছেন, বিশেষ করে যারা সিনিয়র, তারা নিজেদের ব্যক্তিগত কোনো প্রত্যাশা করেন না। তারা দেশের ভালো চাচ্ছেন, জনগণের ভালো হোক-এটাই প্রত্যাশা করছেন। তিনি বলেন, একনায়কতন্ত্র দেশটিকে দুর্ভিক্ষে নিপতিত করেছে, ব্যাংকগুলোকে লুটে নিয়ে অর্থনৈতিক সেক্টরে কঠিন সংকট এনে দিয়েছে, লুটের এ টাকাগুলো উদ্ধারের পরিকল্পনা করে এবং দুর্নীতিবাজদের যদি সাজা দিতে পারে তাহলে বড় কাজ হবে। আরেকটি বিষয় হলো, আইনের শাসন কায়েম করা। এটা খুবই কঠিন। অবশ্যই আইনের শাসন এক দিনে হয় না। সময় লাগে, প্র্যাকটিস লাগে। আইনের শাসন কায়েম হলে গণতন্ত্র অটোম্যাটিকেলি চলে আসবে। যদি গণতান্ত্রিক চর্চা ঠিকমতো হয় তাহলে মানুষের যে অধিকার, অধিকারবোধ-এটা জেগে ওঠে। মানুষের অধিকারবোধ যদি জাগে তাহলে কে অন্যায় করছে তারা তার প্রতিবাদ করবেই। এভাবে প্রতিবাদ জোরালো হলেই আইনের শাসন কায়েম হবে। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি, একটির সঙ্গে আরেকটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সাবেক প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, অধিকারবোধ হচ্ছে গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত। অফিস-আদালতে ঘুষ গ্রহণের প্রবণতা, এটা কি আমেরিকার মতো উন্নত দেশে সম্ভব? যদি কেউ ঘুষ চায় তাহলে নির্ঘাত তাকে জেলে যেতে হয়। একজন নাগরিকের প্রত্যাশা রাষ্ট্রের প্রতি। এটা থাকতে হবে এবং গণতন্ত্রের চর্চাও থাকতে হবে।

যে কারণে তাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে, দেশে ফিরে এ ব্যাপারে আইনগত কোনো পদক্ষেপ নেবেন কি না জানতে চাইলে এস কে সিনহা বলেন, আমার আসলে কোনো কিছুই করার আকাক্সক্ষা-আশা নেই। দেশে গেলে হয়তো এটুকু করতে হবে-দেশে মেধার বড় অভাব। আইনের শাসনের ক্ষেত্রে অনেক ত্রুটি আছে। আমি এখানে থাকলেও অনেকে বাংলাদেশ থেকে টেলিফোন করেন, এখানকার সচেতন মানুষেরাও জানতে চান, আমেরিকা থেকেও নানা বিষয়ে ব্যাখ্যা চান। এটুকু আমি প্রত্যাশা করি যে, কিছু লোক উপকৃত হবে। অনেক দিন আগে থেকেই বিচারকগণ আমার কাছে আসতেন, আলাপ-আলোচনা করতেন উদ্ভূত কোনো পরিস্থিতি অথবা আইনের জটিলতা সম্পর্কে। আইন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা না থাকলে অথবা ভুল ধারণা থাকলে সেটি আমি ভেঙে দিতে পারব। আইনজীবীরা যদি আসেন কমপ্লিকেটেড ম্যাটার নিয়ে, আমি তাদের অ্যাডভাইস দিতে পারব। দেশে ফেরার পর এ ধরনের একটি ব্যবস্থা করা হলে আমারও সময় কেটে যাবে, জনগণও উপকৃত হবে।

তিনি বলেন, কোনো মামলার ব্যাপারে সরকার যদি আমার মতামত চায় তাহলে আমি সেটি দিতে পারব। তা করতে আমি প্রস্তুত আছি। দেশে ফেরার প্রশ্নে এস কে সিনহা বলেন, কবে নাগাদ সরকার আমার সিকিউরিটি দেবে, তার ওপর নির্ভর করবে দেশে ফেরা। আমার ফ্যামিলির নিরাপত্তার প্রশ্ন, আমার স্ত্রীর নিরাপত্তার প্রশ্ন রয়েছে। সিকিউরিটির নিশ্চয়তা পেলেই আমি চলে যাব।

তিনি বলেন, দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসেনি এখন পর্যন্ত। গভর্নমেন্ট এখনো পুলিশ ফোর্স বা অন্য ফোর্সগুলো, বিশেষ করে পুলিশ ফোর্সের পুরোপুরি কন্ট্রোল নিতে পারেনি। পুলিশ স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারলেই স্বাভাবিক অবস্থা আসবে, তখন অবশ্যই আমি ফিরব। সঙ্গে সিকিউরিটির প্রসঙ্গটিও রয়েছে। ৩-৪ দিন আগে শুনলাম, মিলিটারির পোশাক পরিহিত এক ব্যক্তি একজন ব্যবসায়ীকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। এটা তো খুব খারাপ জিনিস। বাংলাদেশে এই যে খারাপ প্র্যাকটিস শুরু হয়েছে, তা দূর করতে হবে। সরকারকে নিশ্চয়তা দিতে হবে প্রত্যেকটি নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তার।

বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশে হিন্দু কমিউনিটি চোখ বন্ধ করে আওয়ামী লীগকে সাপোর্ট দিয়েছে। দু-একজন ছাড়া কেউই অন্য কোনো দলকে সাপোর্ট দেয়নি। যারা এত অন্যায় করল তাকেও (আওয়ামী লীগকে) দ্ব্যর্থহীন সমর্থন দেওয়া, কেন? অথচ আওয়ামী লীগ আমলে যতগুলো আক্রমণ, নির্যাতনের ঘটনা হিন্দুদের বিরুদ্ধে ঘটেছে, একটিরও বিচার হয়নি। এত অন্যায়-অবিচার সত্ত্বেও শেখ হাসিনার প্রতি হিন্দুরা অবিচল আস্থাশীল ছিল বলেই অন্য দলের লোকজনের ক্ষোভের মুখে পড়েছেন বাংলাদেশের হিন্দুরা। সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা কানাডার নির্বাসিত জীবন ছেড়ে মাতৃভূমিতে ফিরতে চান। তবে এজন্য নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চান তিনি। সরকার তাকে জনগণের কল্যাণে ব্যবহার করতে চাইলে সহযোগিতা দিয়ে যাবেন বলেও বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান তিনি। লেখাপড়া করেই এখন সময় কাটছে তার। দেশে আইনের শাসন, গণতন্ত্রের চর্চার অভাব নিয়ে ইংরেজিতে আরেকটি বই লিখছেন, যা শিগগিরই প্রকাশ পাবে।

[hupso]