» ভেজাল ডায়মন্ড আগেই সরান দিলীপ

প্রকাশিত: 04. September. 2024 | Wednesday

ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিলীপ কুমার আগরওয়ালার বিরুদ্ধে সোনা ও ডায়মন্ড চোরাচালানের অভিযোগ তদন্ত শুরু করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। গণমাধ্যমে এ খবর প্রকাশের পর গত মঙ্গলবার সব শোরুম থেকে ভেজাল ডায়মন্ড সরিয়ে ফেলা হয়েছে। দেশের অন্যান্য জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানগুলো গয়না বিক্রির সময় আন্তর্জাতিক মানের হলমার্ক কোম্পানির সনদ দিলেও ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের বিক্রি করা গয়নার সনদ দেওয়া হতো দিলীপ আগরওয়ালার প্রতিষ্ঠান থেকে। দিলীপ আগরওয়াল নিজেই এই সনদ দিতেন।

মঙ্গলবার রাতে র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তারের পর গতকাল আদালতে হাজির করা হয় দিলীপ আগরওয়ালাকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ছাত্রহত্যার অভিযোগে দায়ের করা হত্যা মামলায় তাকে সাত দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়। আদালত তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আমদানি না করেও দেড় দশক ধরে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের ২৮টি শোরুমে ডায়মন্ডের অলংকার বিক্রি করত দিলীপ কুমার আগরওয়ালার ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড লিমিটেড। ২০০৫ সালে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের যাত্রা শুরু হলেও দিলীপ কুমার আগরওয়ালা বেপরোয়া হয়ে ওঠে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর। তখন থেকেই শুরু হয় ভেজাল ডায়মন্ড বিক্রি। দিলীপ কুমার আগরওয়ালার বিরুদ্ধে মোজানাইট কিংবা জারকান পাথরকে আসল হীরার গ্যারান্টি দিয়ে প্রতারণার অভিযোগ ওঠে ২০১৭ সালেই। পরবর্তীতে ওই বছরের ১৮ অক্টোবর কমিটি গঠন করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তদন্ত আর এগোয়নি। অন্যদিকে দুদকের তদন্তের পর ২০১৮ সালে প্রথম হীরা আমদানি করে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড। ওই বছর তিন হাজার ক্যারেটের অমসৃণ হীরার দুটি চালান আমদানি করে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড লিমিটেড। তারপর আর কোনো ডায়মন্ড আমদানি করেনি দিলীপ আগরওয়ালা। দুটি চালান ছাড়া দেড় দশক ধরে আর কোন ডায়মন্ড আমদানি না করেও ডায়মন্ড বিক্রি করছে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড। অভিযোগ রয়েছে দিলীপ কুমার আগরওয়ালা ডায়মন্ডের নামে মোজানাইট কিংবা জারকান পাথর বিক্রি করছে। মোজানাইট কিংবা জারকান পাথর মূলত এক ধরনের কাচ, যা বিশেষ ব্যবস্থায় তৈরি হওয়ায় দীর্ঘ সময় চকচকে দেখায়। জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা জানান, সোনা ও ডায়মন্ডের গয়না বিক্রির সনদ দিতে আন্তর্জাতিক মানের হলমার্কিং কোম্পানির অনুমোদিত দেশি কোম্পানি থেকে। এই চকচকে পাথর বিক্রি করতে দিলীপ নিজেই সার্টিফিকেট দিতেন। নিজেদের প্রতিষ্ঠানের সার্টিফিকেশন নিজেরা করা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল বলেও মনে করেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা। শুধু তাই নয়, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড থেকে ক্রয় করা গয়না অন্য কোনো জুয়েলারি দোকানে ফেরত অথবা বিক্রি না করারও পরামর্শ দিত প্রতিষ্ঠানটির বিক্রয়কর্মীরা।
সিআইডি বলেছে, প্রতারণার মাধ্যমে দিলীপের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জেলায় নামমাত্র শোরুমের মাধ্যমে প্রকৃত ডায়মন্ডের বদলে উন্নত মানের কাচের টুকরাকে ডায়মন্ড বলে বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। তিনি দুবাই ও সিঙ্গাপুরে সোনা চোরাচালান সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ, ভারতের কলকাতায় তিনটি জুয়েলারি দোকান ও ১১টি বাড়ি এবং মালয়েশিয়া, দুবাই ও কানাডায় বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন বলে তথ্য রয়েছে। এ ছাড়া নানাভাবে প্রতারণার মাধ্যমে ৪০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে অবৈধভাবে একটি ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার অভিযোগ পাওয়ায় সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট দিলীপ কুমার আগরওয়ালা এবং এর স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে অনুসন্ধান শুরু করেছে। এমন খবর ছড়িয়ে পড়ার পর ঢাকাসহ সারা দেশে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ২৮টি শোরুম থেকে ভেজাল ডায়মন্ড সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

তিন দিনের রিমান্ডে দিলীপ কুমার আগরওয়ালা : আদালত প্রতিবেদক জানিয়েছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে বাড্ডায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বিএনপিকর্মী হৃদয় আহম্মেদকে (১৬) গুলি করে হত্যার ঘটনায় এ মামলা হয়। এই মামলার আসামি হিসেবে গতকাল তাকে ঢাকার সিএমএম আদালতে হাজির করে পুলিশ। এরপর মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তাকে সাত দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসান তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

মামলার সূত্রে জানা যায়, গত ১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে গুলিবিদ্ধ হয়ে বিএনপিকর্মী হৃদয় আহম্মেদ মারা যান। এ ঘটনায় গত ২২ আগস্ট মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসেন বাদী হয়ে হত্যা মামলা করেন। মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর বোন শেখ রেহানা, শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়সহ ১৬১ জনকে আসামি করা হয়।

দিলীপ-দোলনের বিরুদ্ধে ৫ হাজার কোটি টাকার মানহানি মামলা: বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস) থেকে বহিষ্কৃত এনামুল খান দোলন এবং দিলীপ কুমার আগরওয়ালার বিরুদ্ধে ৫ হাজার কোটি টাকার একটি মানহানি মামলা হয়েছে। বাজুসের উপদেষ্টা রুহুল আমিন রাসেল মামলাটি দায়ের করেন। গতকাল দুপুরে মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেন অ্যাডভোকেট চৌধুরী গালিব রাকিব। তিনি বলেন, বাজুসের উপদেষ্টা রুহুল আমিন রাসেল এনামুল খান দোলন এবং দিলীপ কুমার আগরওয়ালার বিরুদ্ধে আদালতে মানহানির মামলা দায়ের করেন।

মামলার এজাহারে বলা হয়, এনামুল খান দোলন এবং দিলীপ কুমার আগরওয়ালা বাজুসের বর্তমান কমিটিকে বাইরে অবৈধ বলে প্রচারণা চালাচ্ছিলেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ সরকার স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের কাছে থেকে যে ভ্যাট পায়, তা সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে যেন কমানো হয় সেজন্য কমিটিকে তারা দুজন বারবার চাপ প্রয়োগ করছিলেন। অন্যদিকে, সরকার যেন নির্ধারিত ভ্যাট পায় সে লক্ষ্যে কাজ করে বর্তমান কমিটি। এতে করে দোলন ও দিলীপ ক্ষিপ্ত হয়ে বর্তমান কমিটির বিরুদ্ধে বিভিন্ন কুৎসামূলক রটনা চালাতে থাকেন। কখনো লিফলেটের মাধ্যমে বা কখনো বিভিন্ন মিডিয়াকে ব্যবহার করে। অ্যাডভোকেট চৌধুরী গালিব রাকিব জানান, লাগাতার অপপ্রচার চালানোর দায়ে গতকাল এনামুল খান দোলন এবং দিলীপ কুমার আগরওয়ালার বিরুদ্ধে ৫ হাজার কোটি টাকার মানহানির মামলা করা হয়। এই মামলা দায়েরের পর আদালত আসামিদের হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

দোলন এখন কোথায় : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুবক হত্যা মামলার অন্যতম আসামি বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সাবেক প্রেসিডেন্ট এনামুল হক খান দোলন এখন কোথায়? একই মামলার আরেক আসামি দেশের শীর্ষ সোনা ও হীরা চোরাকারবারি দিলীপ আগরওয়ালা গ্রেপ্তারের পর এমন প্রশ্ন এখন সামনে চলে এসেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছে, দোলন হত্যা মামলার আসামি হয়েও দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। তবে পুলিশ ও র‌্যাব জানিয়েছে, তাকে গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। শেখ সেলিমের সোনা পাচারের অন্যতম সহযোগী এই দোলনের খোঁজে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানো হচ্ছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ধানমন্ডি এলাকায় শুভ নামে এক যুবকের মৃত্যুর ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৩৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ মামলায় আসামি করা হয়েছে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের এমডি দিলীপ কুমার আগরওয়ালা, বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সাবেক প্রেসিডেন্ট এনামুল হক খান দোলনকে। গত সোমবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বেগম ফারাহ দিবা ছন্দার আদালতে ভিকটিমের মা রেনু মামলাটি করেন। আদালত পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)-কে অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় গত ১৯ জুলাই ধানমন্ডি থানাধীন ৩ নম্বর রোডে গুলিবিদ্ধ হন শুভ। পরদিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।

[hupso]